হ্যান্ডমেড প্রোডাক্ট – লাইভ মিউজিক – ব্র্যান্ডিং

আমার কাছে একজন গায়ক বা একটা ব্যান্ডের লাইভে গাওয়া গান আর এলবামের গানের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। এলবাম এ যে গান যায়, সেইটা অনেক গুলা প্রসেসিং এর মধ্যে দিয়া যায়। উদাহারন দেইঃ

ধরেন আপনি নদীর পাড়ে গেছেন, সেইখানে মাছ ধরে আনলো একজন জেলে। ওখানে মাছটা কেটে মশলা মাখায় ভেজে দিলো, সেইটা খেতে একরকম। আবার সেই মাছ টা কিছু কেমিকেল দিয়ে প্যাকেটজাত করে সুপারশপের শেলফে রেখে দেয়া হইলো এক সপ্তাহ, আপনি কিনে এনে ভেজে খাইলেন। দুইটার মধ্যে টেস্টের, ফ্লেভারের পার্থক্য আছে না বিশাল?

লাইভ মিউজিকের ব্যাপার টা অনেকটা ওরকম। এলবামে যাওয়ার আগে একটা গান ১০০ বার টেক নেওয়া হইতে পারে, কোন টেকে একটা অংশ ভালো গাইছেন হয়তো আর্টিস্ট, আরেক টা আরেক অংশ, গলা উঠানামার ব্যাপার আছে, সুর, তাল, লয় সবকিছুর ব্যাপার আছে। এগুলা রেকর্ড করে নানারকম টিউনিং করে একটা প্রপার জিনিষ বানায় এলবাম বা এখনকার ইউটিউব বা স্পটিফাই তে দেয়া হয় এলবামের গান।

অন্যদিকে লাইভ যখন পারফমেন্স করতেছেন আর্টিস্ট, সেইখানে আসলে তিনি নিজের পুরাটা দিয়ে চেষ্টা করেন। ভুলের সুযোগ নাই, আরেকবার গাওয়ার সুযোগ নাই। ওখানের আর্টিস্ট বা ব্যান্ড টার “যোগ্যতার” লাইভ প্রমান পাওয়া যায়। যেকোন গান ভালো লাগলে এজন্য আমি লাইভ টা বেশী শুনি। লাইভে যে র খাটি টেস্ট, প্রসেসড এ সেই টেস্ট টা তো নাই।

এইদিকে হাতের কাজের জিনিষের দাম বাংলাদেশে ঠিক তেমন না থাকলেও যারা কদর বুঝেন, তারা কেনেন। আসলে আমাদের দেশে ভাত আনতে নুন ফুরোয় অবস্থায় মানুষের জন্য সবথেকে কম খরচে বেশী বানানো যায়, এমন প্রডাক্ট এর চাহিদা বেশী থাকবেই, এটা স্বাভাবিক।

কিন্তু একটু উন্নত দেশগুলোতে হাতের কাজ, হ্যান্ডমেইড শব্দটাই একটা প্রডাক্ট এর ভ্যালু কয়েকগুন বাড়ায় দেয়। যারা জানেন, বুঝবেন আমাদের দেশে তৈরী একটা নকশী কাথা কি একটা জামদানী শাড়ির মার্কেট ভ্যালু কেমন ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে। ওরা একসময় খেটেছে, এখন ওদের বেশীরভাগ কাজ মেসিন করে, কিন্তু অতীত ভুলে যায় নাই, সো হাতের কাজের মুল্য দেয়।

আমি তো ওয়েব ডিজাইন করি, থিমফরেস্টের একটা থিম কিনে এদিক সেদিক করতে আমি কত চার্জ করবো, ২০০ ডলার ম্যাক্স। বাট যখন বিড করার সময় উল্লেখ করে দেই হ্যান্ডকোডেড, ভাই ৫০০-১০০০ এর নিচে আমারে পাইবেন না। যেটা একেবারেই ছোট বিজনেস, ধরা যাক মুলধন ৫ লাখ টাকা, তাদের তো আসলে একেবারে কাস্টম একটা প্রজেক্ট করে ওয়েবসাইট বিল্ড করার জন্য ওরকম বাজেট ও থাকে না। তাদের জেনেরিক একটা ওয়েবসাইট থাকা দিয়া কথা। বাট যেই বিজনেস টা শুরু হয়েছে ১০ কোটি দিয়ে, তাদের ওয়েবসাইটের পেছনে ০.১% ব্যায় করতে গায়ে লাগে না।

ডিরেক্ট আর্ট বাদ দেন, জাস্ট কল্পনা করেন, একটা মেসিন, একটা গাড়ি ধরেন উদাহারন হিসেবে। টয়োটার একটা সেডান কার কত হবে ব্র্যান্ড নিউ আজকে বাংলাদেশে? ৪০ লাখ? একটা স্টেজে যেয়ে একজন মানুষের মোট সম্পদের পরিমান মিলিওনিয়ার পর্যায়ে যেয়ে ঠেকে। ডলারের হিসেবে আজকের বাংলাদেশে মোট মাল্টি মিলিওনিয়ার এর সংখ্যা ১ লাখ ৪ হাজারের উপরে। অর্থাৎ এই পরিমান মানুষের কাছে ১০০ কোটি টাকার উপরে আছে। সাদা কালো টাকার হিসেবে না যাই আমরা।

এই মানুষ গুলোর গাড়ি দরকার। তার ঐ টয়োটা গাড়িটা নিয়ে বের হবা মানে তার সার্কেলের অন্য সবাই তারে নিয়ে হাসবে। এখন উনি কি করবেন? গাড়িতে ৪ টার যায়গায় ৬ টা চাকা লাগাবেন? একটার যায়গায় তিনটা ইঞ্জিন লাগাবেন? যেহেতু প্র্যাকটিক্যাল না, তখন যেয়ে তিনি হ্যান্ডমেড প্রডাক্টে মুভ করেন। তিনি মার্সিডিজ বা BMW দের ঝুকেন। যেখানে সিটের সিলাই গুলো হাতে করা, হাতে পালিশ করা গাড়িটার বডি। যখন আরো উপরে উঠেন, তখন যেয়ে হাত দেন মেবি একেবারেই প্রায় ৮০% হাতে তৈরী প্রডাক্টে, রোলস রয়েস এ।

একটা ব্র্যান্ড কেন এই শ্রেনীর মানুষদের টার্গেট করবে?

১। তার পারচেসিং পাওয়ার অফকোর্স নাম্বার ওয়ান। তার কেনার ক্ষমতা আছে, একটা জিনসের প্যান্ট এর জন্য তাকে ৩০ হাজার টাকা চার্জ করলেও তার ব্যাংক একাউন্টের নাম্বার টায় যে চেঞ্জ হবে, তার চোখ খেয়াল ই করবে না।

২। হাই প্রফিট মার্জিনঃ এগুলো প্রডাক্টে যেহেতু কাস্টমার এর ভ্যালু হাই, সেক্ষেত্রে প্রফিট মার্জিন ও হাই। ঐ ৩০ হাজার টাকার প্যান্ট তৈরী করতে কি ৩ হাজারের একটা প্যান্ট থেকে ১০ গুন বেশী খরচ হয়েছে? অসম্ভব। বাট তাকে চার্জ করা যায় ১ নাম্বার কারনে।

কিভাবে টার্গেট করবে?

১। কোয়ালিটি ফার্স্ট। প্রডাক্টের কোয়ালিটি অফকোর্স সর্বোচ্চ মানের হতে হবে। সেইম সেগমেন্টে অন্য কোন কম্পানী এর থেকে ভালো প্রডাক্ট দিতেই যাতে না পারে সেইটা প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে।

২। প্রেজেন্টেশনঃ শোরুম হোক বা ওয়েবসাইট, কাস্টমার সার্ভিস বা সেলস ম্যান, পুরো ব্যাপার টাতেই লাক্সারী স্যাটিসফিকশন ফিল তো দিতে হবে এরকম একজন লিড কে কাস্টমার বানাতে।

৩। প্রপার ব্র্যান্ডিং, এটা কালার চয়েজ, লোগো থেকে শুরু করে সবকিছুই। ব্র্যান্ডের একটা ম্যাসেজ থাকবে। হইতে পারে তারা দেশের সবথেকে আদি ব্র্যান্ড, হইতে পারে তারা সবথেকে বেশী ইনোভেটিভ ব্র্যান্ড।

৪। দা এক্সট্রা লাইনঃ আর দশজন তো বেসিক সবকিছুই করে। ব্র্যান্ড এর প্রতিটা ইঞ্চি বা প্রতিটা পিক্সেল পারফেক্ট তো হবেই, তারা এক লাইন বেশী করবে। খুব হাই এন্ড একটা ব্র্যান্ডের শোরুমে ঢুকে ৫ তারকা হোটেলের ফিল পাবেন আপনি, কোথাও একটা দাগ থাকবে না তাদের, প্রডাক্টে কোথাও একটা সুতা থাকবে না। একটা দেশী এজেন্সী Yellow Bangladesh এর ওয়েবসাইট টা বানাইছে, ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সাইট, তাদের এক্সট্রা লাইন টা কি? ওয়েবসাইটে পিসি থেকে ঢুকে আমি প্রডাক্টের ছবির উপর মাউস নিয়ে গেলাম, ব্যাস, একজন মডেল হেটে আসলেন ঐ প্রডাক্ট টা গায়ে দিয়ে।

যেখানে বেশীরভাগ ব্র্যান্ড একজন মডেল হায়ার করে তারে দিয়ে যতগুলা বেশী সম্ভব ড্রেস পড়ায় ছবি তুলায় ফেলতে পারলে বাচে, সেখানে ইয়েলো প্রতিটা প্রডাক্ট লঞ্চের জন্য একজন মডেল হায়ার করে, তার ফটোশুট করে, ভিডিও করে তার হেটে আসা। এডিট করে তারপর ওয়েবসাইটে প্রডাক্ট দেয়।

ব্র্যান্ডিং বিশাল বড় একটা ছাতা, মার্কেটিং এর ছোট অংশ মাত্র। নেক্সট কোন একটা প্রজেক্টে আমি কিভাবে মিডলম্যান হিসেবে কাজ শুরু করি একটা সদ্য জন্মানো কম্পানী নিয়ে স্টেপ বাই স্টেপ লিখবো, যদি আপনারা অন্তত ২০ জন মানুষ ও পড়েন। যদি এই লম্বা লেখাটা পড়েন, আপনার প্রিয় বাংলাদেশী ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নাম টা কমেন্টে লিখবেন প্লিজ, মনে চাইলে কারন টাও।